১. ইউক্রেন: ইউরোপের যুদ্ধ এবং আমাদের শিক্ষণীয়  


১. আবার লেনিন!

ইউক্রেনের সংকট শেষাবধি যুদ্ধে গড়ালো। তথাকথিত স্নায়ু যুদ্ধের অবসানের পর অনেকে এই আশা করেছিলেন যে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা এবং যুদ্ধ বিগ্রহের দুর্দশায় বিশ্বকে পড়তে হবে না। মানুষের বৈষয়িক সমৃদ্ধি এবং নৈতিক বিকাশের দিকে নজর দেওয়া সহজ হবে। কিন্তু ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের 'সাম্রাজ্যবাদ' সংক্রান্ত তত্ত্ব সত্য বলে বারবারই প্রমাণিত হয়েছে। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বৈশিষ্টই হচ্ছে হানাদারি এবং যুদ্ধ । ইউক্রেন যুদ্ধ  সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের অনন্ত যুদ্ধের কালপর্বের পর গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ঘটনা। যা নতুন করে পুরানা সত্যকে যেমন আমাদের সামনে হাজির করছে, তেমনি বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের নতুন ভাবে ভাবতেও বাধ্য করছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়া শুরু হয় ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যে। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসান ঘটে। রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়ার হাত থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন চেষ্টা করে নি তা নয়, কিন্তু মিখাইল গর্বাচেভের সংস্কার চেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়ে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেকে 'সমাজতান্ত্রিক' দাবি করলেও তাকে বানানো হয়েছিল পাশ্চাত্যের মতো কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক রাষ্ট্র হিশাবেই। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনকে শুধু ‘সমাজতন্ত্র’ ব্যর্থ হয়েছে ভাবলে ভুল হবে, বরং পাশ্চাত্যের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দ্বারা তথাকথিত ‘সমাজতন্ত্র’ কায়েমের ব্যর্থতা হিশাবেও বোঝার দরকার আছে। অর্থাৎ দুই প্রকার ব্যর্থতার দিকে আমাদের নজর নিবদ্ধ করতে হবে। এক.  'সমাজতন্ত্র' নামের বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যর্থতা। দুই. পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা কেন্দ্রীভূত আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার গলদ।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বেশ কয়েকটি প্রজাতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র। যে প্রজাতন্ত্রগুলো বিভিন্ন জাতিসত্তার স্বদেশ হিসাবে কাজ করেছিল। ১৯৯১ সালের শেষের দিকে রাজনৈতিক সংকটের ডামাডোলের মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকটি প্রজাতন্ত্র ইউনিয়ন ছেড়ে চলে যায়। ফলে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নৈতিক ও রাজনোইতিক বৈধতা হারিয়েছে। যারা তিনটি প্রজাতন্ত্রকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিশাবে ঘোষণা এবং প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেই নেতারাই ঘোষণা করেছিলেন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর নাই। এর পরেই আরও আটটি প্রজাতন্ত্র তাদের ঘোষণায় যোগ দেয়। মিখাইল গর্বাচেভ ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেন। এর মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে যাকে পুঁজিতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মধ্যে যাকে Cold War বলা হয় তার অবসান ঘটে। কোল্ড ওয়ারের বাংলা করবার দুই রকম চল রয়েছে: স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডা যুদ্ধ। ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটা একই সঙ্গে সাম্রাজ্যাবাদী রাষ্ট্র হিশাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল উত্থান এবং বিশ্ব ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার মধ্য দিয়ে একটা এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটভূক্ত দেশগুলো নিয়ে বিশ্ব ব্যাপী একটা সামরিক , পুঁজিতান্ত্রিক এবং আদর্শিক আধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হয়। মার্কন সাম্রাজ্যবাদ বাস্তবে এখন কিভাবে কাজ করে বুঝতে হলে শুধু পুঁজির গোলকায়ন,  ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন, সামরিক নীতি ও মারণাস্ত্র উৎপাদনের অর্থনীতি ইত্যাদি বুঝলে চলবে না। এই আধিপত্য একই সঙ্গে চরম আদর্শিক এবং আমাদের চিন্তাচেতনা মস্তিষ্ক মগজের ওপর হান্মাদারি ও দখলদারিরও মামলা। অর্থাৎ আদর্শগত।  যেমন, পাশ্চাত্য যাকে 'লিবারেলিজম' বা উদার রাজনৈতিক আদর্শ গণ্য করে তাকে পুঁজিতন্ত্র থেকে যেমন আলাদা করা যায় না, একই ভাবে মার্কিন সামরিক আধিপত্য বা আগ্রাসন থেকেও আলাদা করা চলে না। সেকুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শ হিশাবে আধুনিকতাপন্থিরা লিবারেলিজমকে তাদের বিশ্বাস বা  'ধর্ম' জ্ঞান করে। শুধু তাই নয়, একে মতাদর্শিক ভাবে চ্যালেঞ্জ বা মোকাবিলার জন্য যে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ আমাদের সমাজে দরকার তারা তার বিরুদ্ধে চরম প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান গ্রহণ করে এবং নিপীড়িত জনগোষ্ঠির স্বার্থের বিপক্ষে দাঁড়ায়।

লিবারেলিজমের দুটো দিক আছে। একটি হচ্ছে তার আদর্শিক বা দার্শনিক দিক – তথাকথিত ‘আধুনিকতা’র গোড়ার আদর্শিক অনুমান হিশাবে সেটা হাজির থাকে এবং আমাদের মনমানসিকতা  ও চিত্তবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর সেকুলার ও আধুনিকেরা পাশ্চাত্য চিন্তাচেতনা ও প্রপাগাণ্ডাকে সদা সর্বদা সত্য বলে গ্রহণ করে এবং জেনে বা না জেনে পরাশক্তির স্থানীয় বরকন্দাজের ভূমিকা পালন করে।  লিবারেলিজমের অন্যদিকে রয়েছে তার রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক রূপ। এই রূপকে আমাদের কাছে ‘গণতন্ত্র’ নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য পরাশক্তি ফেরি করে বেড়ায়। ইউক্রেন কেন্দ্র করে ইউরোপের এই যুদ্ধকে বাংলাদেশের জায়গা থেকে বুঝতে হলে অবশ্যই ভূ-রাজনৈতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ব্যবস্থার রূপান্তর যেমন বুঝতে হবে, তেমনি ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে বিদ্যমান দার্শনিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শের চরিত্রকেও বুঝতে হবে। শক্তিহীন, দুর্বল ও কার্যত পরাধীন বাংলাদেশের জনগণকে  টালমাটাল বিশ্ব ব্যবস্থায় আমরা কিভাবে পথ দেখাবো সেই নির্দেশনা নির্ণয় করতে হলে আমাদের অবশ্যই  ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং তার থেকে তৈরি হওয়া সামরিক, রাজনৈতিক এবং আদর্শিক লড়াই-সংগ্রামের  প্রকৃতি ভাল ভাবে বুঝতে হবে। ইউক্রেন নিয়ে আমাদের লেখালিখির উদ্দেশ্যও এখানেই নিহিত। 

ইউক্রেন কেন্দ্র করে ইউরোপের যে যুদ্ধ শুরু হোল, সেটা কোথায় থামবে আমরা জানি না। এখনও তা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা বিশ্ব ব্যবস্থার নতুন পালাবদল, পর্বান্তর বা নতুন একটি পর্যায়ে প্রবেশ করছি, এই দিকটি কমবেশী স্পষ্ট। কোন্‌ পর্ব শেষ হচ্ছে আর সামনে কি আসছে সে সম্পর্কে পূর্ণ আলোচনার সময় এখনও আসে নি। যুদ্ধের জয়-পরাজয় বা আপোষ-মীমাংসা সেই পর্বান্তরকে আরও স্পষ্ট করে তুলবে। তবে কিছু লক্ষণ নিয়ে আমরা আলোচনা করতেই পারি। কোন্‌ বিষয়গুলো বাংলাদেশে আমাদের জন্য বোঝা দরকারি তার কিছু ইঙ্গিত  ইউক্রেন নিয়ে আমাদের প্রথম লেখাটিতে দেওয়া আমাদের ইচ্ছা। লেনিন সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃতি সম্পর্কে যে তত্ত্বগত পর্যালোচনা করেছিলেন তার তাৎপর্য এবং সীমাবদ্ধতাও আমাদের কাছে  এতে আরও স্পষ্ট হবে

২. বিশ্ব অলিগার্কদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা

ইতিহাসের প্রহসন যে ক্রেমলিন এই যুদ্ধ শুরু করেছে বলে এই যুদ্ধ শুরুর দায়ভার রাশিয়াকেই বহন করতে হবে। এর পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা আমরা এখনই বুঝতে না পারলেও ফলাফল নির্বিশেষে যুদ্ধ যে প্রভূত ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায় এই যুদ্ধে তার ব্যাতিক্রম ঘটবে না। ঘটছেও না। তাই ইউক্রেনের প্রতি সহানুভূতির ব্যাপক ঢেউ উঠেছে। পুতিনের প্রতি নিন্দামন্দেরও শেষ নাই। রাশিয়াতেও স্বতঃস্ফূর্ত যুদ্ধ-বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনীয়দের প্রতি সংহতির ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের পক্ষপাত রয়েছে। সেখানে পাশ্চাত্যের বর্ণবাদী রূপটাই শরণার্থীদের প্রতি আচরণে বোঝা গিয়েছে। কিন্তু আমাদের বিশেষ ভাবে বুঝতে হবে ইউক্রেনের উপর এক দশকের দীর্ঘ ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে শক্তিশালী পক্ষ হিশাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটো মিত্ররা আক্রমণের প্রেক্ষাপট গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।

রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধ হঠাৎ শুরু হয়েছে এমন নয়। রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে রুশ ফেডারেশানের অন্তর্ভূক্ত করে নেয়। ক্রিমিয়া রুশভাষী অঞ্চল। ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বে গৃহযুদ্ধ চলছে অনেকদিন ধরে। একটা শান্তিচুক্তি হয় ২০১৫ সালে, একটা আপোষ-মীমাংসার চেষ্টা আছে, কিন্তু যুদ্ধের তীব্রতা কমলেও দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই থামে নি। ইউক্রেনের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিক থেকে দেখলে এখনকার যুদ্ধের দৃশ্যমান শুরু ২০১৪ সালে, ইউক্রেনের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এবং তাদের সমর্থকদের ভাষায় ‘ইউরো-মাইদান’ বিক্ষোভের শেষের দিকে ‘মাইদান বিপ্লব’এর মধ্য দিয়ে। ইউক্রেনে রাশিয়া সমর্থিত ভিক্টর ইয়ানোকোভিচ সরকারের পতনের পর ক্রিমিয়াকে রাশিয়া নিজের অন্তর্ভূক্ত করে নেয়। এ নিয়ে একই বছর ১৬ই মার্চে একটা রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠিত হয় এবং যার ভিত্তিতে ক্রিমিয়া নিজেকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিশাবে রাশিয়ার যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ সেটা মেনে নেয় নি। ইউক্রেনে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনমতও রয়েছে। পাশ্চাত্য এবং ইউক্রেন পক্ষাবলম্বীর কাছে এই রেফারেন্ডাম বিতর্কিত। তবে ইউক্রেনের গৃহযুদ্ধের মাত্রা বোঝার জন্য পেছনের এইসকল বাস্তব ইতিহাস মনে রাখা জরুরি।

দুই হাজার তেরো সালে তখনকার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ইয়ানোকোভিচ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেবেন না, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য চুক্তিও স্বাক্ষর করবেন না -- বরং রাশিয়ার সঙ্গে সম্বন্ধ আরও দৃঢ় করবেন। ইউক্রেনের জনগণের যে অংশ ইউরোপের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যসহ আরও গাঢ় সম্বন্ধ স্থাপন চায় এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিতে আগ্রহী তারা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে এবং বিক্ষোভ সংগঠিত করে। সেই বছর ইউক্রেনের জাতীয় পার্লামেন্ট (Verkhovna Rada) ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে সম্বন্ধ করবার চুক্তি বিপুল সমর্থনে পাশ করে। বলা বাহুল্য, রাশিয়া চেয়েছিল এই চুক্তি যেন না হয়। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ কয়েক মাস ধরে চলতে থাকে এবং প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানোভিচের পদত্যাগের দাবি পর্যন্ত গড়ায়। সরকারের দুর্নীতি , ক্ষমতার অপব্যবহার , অল্পকিছু ধনবান গোষ্ঠির রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া, আইনশৃংখলা বাহিনীর নিষ্ঠুরতা এবং মানিবাধিকার লংঘন ইত্যাদির অভিযোগে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তীব্র হয়, রাজধানি কিয়েভের কেন্দ্রে ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কোয়ারে বিক্ষোভকারিরা ক্যাম্প বা অবস্থান গ্রহণ করে। এটাই ইউক্রেনের ‘মাইদান বিক্ষোভ’ নামে খ্যাত। পরিণতিতে ইয়ানোকোভিচ ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে যান। যে কারনে একে ‘মাইদান বিপ্লব’ বা The Revolution of Dignity বলা হয়।

তাহলে ইউক্রেনের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পক্ষবিপক্ষের ভাগ মোটা দাগে দুই ভাগে বিভিক্ত। এক ভাগ রাশিয়ার পক্ষে এবং আরেক পক্ষ ইউরোপ এবং মার্কন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পক্ষপাতি। মোটা দাগে ইউক্রেনের যুদ্ধ একদিকে রাশিয়া এবং অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় আধিপত্য বহাল এবং সম্প্রসারণের যুদ্ধে। আরও নানান কারন থাকলেও এই যুদ্ধের মর্মার্থ অনুধাবনের কেন্দ্রীয় জায়গা হচ্ছে ভূ-রাজনীতি।

ইউরোপের এই নতুন যুদ্ধকে বুঝতে হলে নানান দিক থেকে বিচার করা দরকার। পাশ্চাত্য গণমাধ্যম বলা বাহুল্য, যথারীতি তাদের প্রপাগাণ্ডা তীব্র করেছে। সেই প্রপাগান্ডার সারকথা হচ্ছে এই যুদ্ধ প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর পুতিন এবং রাশিয়ার হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ধনি শ্রেণীর যুদ্ধ। ইংরেজিতে যাদের oligarch বলা হয়। কিন্তু অলিগার্ক শুধু রাশিয়ায় রয়েছে তাতো না। বিশ্বব্যাপী বাজার ও ব্যবসার ওপর একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম রাখবার বিভিন্ন ধনি মাস্তান গোষ্ঠি রয়েছে। রাশিয়া ব্যতিক্রম কিছু নয়। যুদ্ধকে বিশ্ব অলিগার্কদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিশাবে দেখার মধ্যে দোষের কিছু নাই।

৩. আমরা টমেটো তোমরা বিষকাঁটা

কিন্তু আমরা টমেটো আর তোমরা বিষকাঁটা – অর্থাৎ মার্কিন ও ইউরোপীয় অলিগার্ক ভাল, আর রুশ অলিগার্কের গায়ে গন্ধ – পাশ্চাত্য প্রচার মাধ্যমে এই প্রকার একপক্ষীয় প্রচার ও মিথ্যা চলছে। একে রাশিয়ার অলিগার্কদের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার প্রপাগান্ডা বলা যায়। যার সারকথা হচ্ছে রাশিয়াই এই ক্ষেত্রে আগ্রাসী। তথ্য হিশাবে এটা সঠিক, কিন্তু তথ্য হিশাবে বিতর্কিত। কারণ যুদ্ধ সংক্রান্ত তত্ত্বে ‘ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ’ (Just War) নামে একটি ধারণা আছে। কিন্তু দোষারোপের মানদণ্ড হাতে এই যুদ্ধকে আমরা বুঝব না। অতএব পাশ্চাত্য প্রপাগান্ডাকে এক চিমটা পুরানা তেলে পোড়া রসুন ভেবে নেওয়াই ভাল। বর্তমান যুদ্ধ – অর্থাৎ বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার গভীর সংকটের কুলকিনারা করতে পারার সামর্থ অর্জনের ওপর আমাদের জোর দিতে হবে। কেবল ইয়খনই এই যুদ্ধ থেকে বাংলাদেশে আমাদের শিক্ষণীয় দিকটা আমরা ধরতে পারবার সামর্থ অর্জন করব।

আমরা জানি প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছে। বর্তমান রাশিয়ার তরফে বারবারই বলা হয়েছে যেসব দেশ প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশের মর্যাদা পেয়েছে তাদের যেন পাশ্চাত্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত করা না হয়। বিশেষত কোন ভাবেই যেন তাদের মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর (North Atlantic Treaty Organization) অন্ত্ররভূক্ত করে নেবার চেষ্টা করা না হয়। রাশিয়া স্বভাবতই তখন তাকে রাশিয়ার নিরাপত্তার হুমকি হিশাবে দেখবে। পাশ্চা্ত্যের উচিত এই উস্কানিমূলক কাজ থেকে বিরত থাকা।

বলাবাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ সেটা মানে নি। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে – বিশেষত রাশিয়ার নিরাপত্তার দিক থেকে শান্তিপূর্ণ ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই দাবি গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপে এখন এই যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার পেছনে ন্যাটো জোটের পুব দিকে আগ্রাসন- অর্থাৎ প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গিয়ে স্বাধীন হওয়া অনেক রাষ্ট্রের ন্যাটোতে যোগদান রাশিয়ার উৎকন্ঠা বাড়িয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক কারনে রাশিয়া সেটা পছন্দ করে নি। ইউক্রেনের পূবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সম্প্রসারণ ছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন ও ইউরোপীয় সমরশক্তির পরিষ্কার উস্কানি। তাই ভ্লাদিমির পুতিনের পুরানা রুশ সাম্রাজ্য ফিরে পাবার বাসনাকে ইউক্রেন যুদ্ধের কারন গণ্য করবার যে প্রচারটা আমরা পাশ্চাত্য গণমাধ্যম থেকে শুনি, তার কোন ভিত্তি নাই। তাকে স্রেফ পাচাত্য গণমাধ্যমের কেচ্ছা ভাবাই ভাল। এর অধিক কিছু গণ্য করা বাতুলতা।

আরেকটি তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হোল গ্যাস লাইন। এটা নর্ড স্ট্রিম ২ নামে পরিচিত। দুই হাজার সালে রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছিল একটা গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন বসানো হচ্ছে । পশ্চিম সাইবেরিয়া থেকে জ্বালানি যাবে জার্মানির লুবমিনে, জার্মানির উত্তর পূর্বে। একটি পাইপলাইন আগে থাকতেই রয়েছে। সেটা নর্ড স্ট্রিম ১ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় পাইপলাইন রাশিয়ার গ্যাস কোম্পানি গাজপ্রম বসাচ্ছে, যার শেয়ারের বড় অংশই রাষ্ট্রীয়। এতে খরচ হচ্ছে এগারো (১১) বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় পাইপ লাইন বসালে বর্তমানের চেয়েও দ্বিগুন গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। বলা হয়, ২৬০ লক্ষ জর্মন নাগিরিকদের বাড়ী এর দ্বারা কম খরচে শীতকালে গরম রাখা যাবে।

কিন্তু এই বছর ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে জর্মন চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ (Olaf Scholz) নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপ লাইনের সার্টিফিকেশান প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কেন? রাশিয়ার দোষ কি? ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে যাওয়া দুটো সদ্য স্বাধীন দেশকে স্বীকৃতি দেওয়া। লক্ষ্যণীয় যে নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপ লাইন রাশিয়া টেনেছে বাল্টিক সাগর ঘেঁষে। এমন ভাবে যেন ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে যেতে না হয়।

৪. মোটাদাগের শিক্ষা

শুরুতে এই যুদ্ধ থেকে মোটা দাগের শিক্ষার দিকে নজর দেওয়া যাক।

এর আগে সেপ্টেম্বর ১১র হামলার অজুহাতে বিশ্ব ব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনন্ত যুদ্ধ শুরু করেছিল। সেটা রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের যুদ্ধ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সেটা ছিল অ-রাষ্ট্রীয় শক্তির (non state actor) বিরুদ্ধে লড়াই। তেল বা জীবাশ্ম-জ্বালানির ওপর দখল কায়েম করা ছিল তার বৈষয়িক দিক। তবে আদর্শিক ভাবে সেটা ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কারণ মতাদর্শ হিশাবে ফ্যাসিজম এবং কমিউনিজমের পরাজয়ের পর পাশ্চাত্যে লিবারেলিজমের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিশাবে হাজির হয়েছে ইসলাম। জর্জ বুশ এই যুদ্ধকে ‘ক্রুসেড’ বলে আরম্ভ করেছিলেন, পরে পরিভাষা বদলিয়ে ইসলামের জায়গায় ‘সন্ত্রাস’ বসানো হয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রদায় হিশাবেও এর টার্গেট ছিল স্পষ্টতই মুসলমান। যেসকল দেশে ধর্মীয় সম্প্রদায় হিশাবে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের সার্বভৌম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলোপ করে দিয়ে তাকে স্রেফ ভূখণ্ড বা টেরিটরিতে পরিণত করা ছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি এখন কতিপয় যুদ্ধবাজ গোষ্ঠির অধীনস্থ ভূখণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়। এই যুদ্ধকে জর্জ বুশের ক্রুসেড বা জিহাদ ভাষ্য দিয়ে না বুঝে ‘পুঁজি’র পুঞ্জিভন এবং আত্মস্ফীতির দিক থেকে বিচার করলে পুঁজির বাস্তব ঐতিহাসিক প্রবণতার মর্ম আমরা সহজে বুঝব। পাশাপাশি পাশ্চাত্যের লিবারেলিজম বা উদার রাজনৈতিক মতবাদ কিভাবে এই যুদ্ধের মতাদর্শ হিশাবে ব্যবহৃত হয়েছে তার তাৎপর্য বোঝা যাবে।

পাশ্চাত্য ইতিহাসের একটা সময় গিয়েছে যখন পুঁজি পাশ্চাত্য দেশগুলোর নিজ নিজ রাষ্ট্রকে আশ্রয় করে হানাদার ও দখলদার হিশাবে বিভিন্ন ভূখণ্ড দখল করেছে, অবাধে সেইসব দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুট এবং তাদের পণ্যের একচেটিয়া বাজারে পরিণত করেছে। এই পর্যায়কে আমরা উপনিবেশের ইতিহাস বলে জানি। ঔপনিবেশিকতার মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্যে পুঁজিতন্ত্রের বিশেষ ধরণের উদ্ভব ঘটে। পরবর্তী কালে পুঁজির আরও পুঞ্জিভবন ও স্ফীতির পরিণতি হিশাবে দুনিয়ার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে পাশ্চাত্য দেশগুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু করে। তথাকথিত প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যার উদাহরণ। এই পর্যায়কে আমরা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ভাষ্য অনুযায়ী ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বা সাম্রাজ্যবাদী পর্ব বলে জানি। যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াও সাম্রাজ্যবাদী কালপর্বে পুঁজির লগ্নি রূপের (Finance Capital) প্রতি লেনিন আমাদের নজর যথার্থই আকর্ষণ করেছিলেন। পুঁজির পুঞ্জিভবন ও আত্মস্ফীতির ক্ষেত্রে ব্যাংকের ভূমিকা সাম্রাজ্যবাদী কাল পর্ব থেকেই স্পষ্ট হতে শুরু করে। এই পর্বের পর পুঁজির বৈশ্বিক রূপ আরও পরিচ্ছন্ন হতে থাকে,  যাকে আমরা এখন ‘গোলকায়ন’ (Globalization) বলে আখ্যায়িত করি। এই কালপর্বে পুঁজির বিচলন চক্র আরও বিস্তৃত ও বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে। পণ্য, মূদ্রা এবং টেকনলজি দেশ বা রাষ্ট্রের বেড়া ভেঙে দিচ্ছে এবং কার্যত রাষ্ট্রকে পুঁজির অধীনিস্থ করে ফেলতে পেরেছে। এই কালে রাষ্ট্র নয় দুনিয়াব্যাপী পুঁজির পুঞ্জিভবন ও আত্মস্ফীতির প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হচ্ছে বহুজাতিক পুঁজি, যা ‘মাল্টিন্যাশনাল’ বা ‘ট্রান্সন্যশনাল’ নামে খ্যাত।

আমরা এমন একটা বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রবেশ করেছি যেখানে বর্তমান পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় খোদ রাষ্ট্রই পুঁজির পুঞ্জিভবন ও আত্মস্ফীতির জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুঁজি অবাধ বাজার চায়, মুদ্রা ও পণ্য বিচলনের ক্ষেত্রে পুঁজি রাষ্ট্রের কোন বাধা বা প্রতিবন্ধকতা চায় না। এই পর্যায়কে আমরা নিউ-লিওবারেল কিম্বা কাছাখোলা ব্যবসার যুগ বলে থাকি । পুঁজি – বিশেষত দুনিয়ার পরম শক্তিধর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আর রাষ্ট্রের বাধা-নিষেধ মানতে রাজি নয়। রাষ্ট্র সম্পর্কে পুরানা তথাকথিত ওয়েস্টফিলিয় (Westphilian Sovereignty) সার্বভৌমত্ব এখন আর নাই। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রায় অন্তঃসারশূন্য ধারণায় পর্যবসিত হয়েছে।

ওয়েস্টফিলিয় সার্বভৌমত্ব বা তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা পাশ্চাত্যে আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে উঠবার সময় গড়ে উঠেছিল। যা একই সঙ্গে একদা রূপ নিয়েছিল আন্তর্জাতিক আইনী ব্যবস্থা হিশাবে – জাতিসংঘের গাঠনিক সূত্র হিশাবে। সার্বভৌমত্বের ধারণা আধুনিক রাষ্ট্রগুলো কাগজেকলমে এতোকাল স্বীকার করে নিয়ে আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এর আইনী মর্ম হচ্ছে প্রতিটি রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের সার্বভৌম অধিপতি, অর্থাৎ কোন একটি রাষ্ট্রকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি দেবার অর্থ হচ্ছে যে-ভূখণ্ডটির ওপর রাষ্ট্রটি গঠিত সেই ভূখণ্ডের ওপর রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা ও এখতিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রও মেনে চলবে বা মেনে চলতে বাধ্য। জাতিসংঘের গাঠনিক সনদে এই নীতি স্বীকৃত। জাতিসংঘের চার্টারে আছে "nothing ... shall authorize the United Nations to intervene in matters which are essentially within the domestic jurisdiction of any state."। ছোট হোক বা বড় হোক প্রতিটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অলংঘনীয়।

কিন্তু পুঁজির পুঞ্জিভবন ও আত্মস্ফীতির মুখে – বিশেষত পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং নিউ-লিবারেল অর্থনীতির উত্থানের পর থেকে নিজ নিজ ভূখণ্ডের ওপর রাষ্ট্রের সার্বভৌম এখতিয়ার তার প্রাচীন তাৎপর্য হারিয়েছে। একালে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিসর শুধু ভূমি বা প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বহুলাংশে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হরণ করে নেবার পাশাপাশি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বও হরণ করছে। যেমন নাগরিকদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেবার সার্বভৌম অধিকারও ক্ষয় পেতে শুরু করেছে। সেটা ঘটছে মানবাধিকারের নামে। রাষ্ট্রের মানবাধিকার লংঘনকারী ক্ষতির হাত থেকে সেই দেশের নাগরিকদের রক্ষা করবার নতুন আন্তর্জাতিক নীতি হচ্ছে মানবাধিকার রক্ষার জন্য সার্বভৌম রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের নতুন আন্তর্জাতিক নীতি। এই নীতি Humanitarian Intervention নামে পরিচিত। এর মূল কথা হোল, শক্তিশালী দেশগুলো মানবাধিকার বা অন্য যে কোন ছুতায় সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে। বলাবাহুল্য এর শিকার হয় দুর্বল রাষ্ট্রগুলো। রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব হ্রাস এবং অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের ক্রম-অবসানের ফলে ‘সার্বভৌমত্ব’ সোনার পাথরবাটির মতো অন্তঃসারশূন্য ধারণায় পর্যবসিত হয়েছে। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের খুব কমই হুঁশ রয়েছে। রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বার্থে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ, দমন ও শায়েস্তা করবার – অর্থাৎ পুঁজির স্বার্থে জনগণকে শাসন করবার, শাস্তি দেবার এবং শৃংখলার মধ্যে রাখবার আইনী ও প্রাতিষ্ঠানিক হাতিয়ার মাত্র।

পুঁজির পুঞ্জিভবন ও স্ফীতির পরিণতি হিশাবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত ধারণার ক্ষয় ধরতে না পারলে এ কালের যুদ্ধ বিগ্রহের চরিত্র বোঝা কঠিন। মধ্য প্রাচ্যের সাম্প্রতিক যুদ্ধ বিগ্রহ রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের যুদ্ধের চাইতেও মূলত তেল কোম্পানি এবং সমরাস্ত্র ব্যবসায়ীদের যুদ্ধ বলাই অধিক সঙ্গত। পুঁজির দিক থেকে দেখলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের (War On Terror) প্রধান অর্থনৈতিক মতলব ছিল মধ্যপ্রাচ্যের তেল প্রধান অঞ্চলগুলোর ওপর দখলদারি কায়েম করে তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের মতাদর্শিক প্রস্তুতি চলছিল দীর্ঘকাল ধরে। সেটা স্যামুলেল হান্টিংটন (The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order) কিম্বা ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার (The End of History and the Last Man) বই থেকে আমরা মোটামুটি একটা ধারণা করতে পারি।

প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে। একে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তুরীয় সাফল্য হিশাবে বিবেচনা করা শুরু হোল। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে নি, একে দেখা হোল সমাজবাদ, সমাজকল্যাণ মূলক আদর্শ বা সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত পরাজয় হিশাব। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা, লিবারেলিজম এবং গণতন্ত্রই শেষাবধি মানবেতিহাসে জয়ী বলে ঘোষণা করা শুরু হোল। ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার ‘এন্ড অব হিস্ট্রি’ নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে এর গুরুত্ব এবং প্রতাপ বিবেচনা করে বই হিশাবে বেরুলো ১৯৯২ সালে। স্যামুয়েল হান্টিংটনের Clash of Civilization বেরুলো ১৯৯৩। মোটা দাগে হান্টিংটন বললেন ভবিষ্যতে যুদ্ধ দেশের সঙ্গে দেশের হবে না, বরং লড়াই হবে সভ্যতার সঙ্গে সভ্যতার। সেই ক্ষেত্রে ইসলাম ও মুসলিম দেশগুলোর জনগণকে যুদ্ধের প্রধান টার্গেট গণ্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের পররাষ্ট্রীয় এবং ভূ-রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণ করতে হবে। সেটাই করা হোল। । মার্কন যুক্তরাষ্ট্রেরএ প্রস্তুতি শুধু সামরিক কিম্বা সাম্রাজ্যবাদী নীতি হিশাবে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়েছে তা নয়, মতার্শিক ভাবে ইসলাম  লিবারেলিজমকে বৈশ্বিক ভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারে সেই ভীতি থেকেও ইসলাম নির্মূল অভিযান চলেছে। তবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ মোকাবিলার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে মুসলমান জনগোষ্ঠির  যে বন্ধ্যাত্ব ও জাহেলিয়াত বাস্তবে আমরা দেখেছি তাতে বোঝা যায় বৈশ্বিক চ্যালিঞ্জ আদর্শিক ভাবে মোকাবিলার সামর্থ ইসলামের অভ্যন্তর থেকে এখনও গড়ে ওঠে নি। ফলে সাম্রাজ্যবাদ ও লিবারেলিজমের প্রতিরোধ মারণাস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবহারের মধ্যে সংকীর্ণ হয়ে রয়েছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং সাম্রাজ্যবাদকে দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে চ্যালেঞ্জ করবার কোন পুষ্ট ধারা আজ অবধি ইসলামের ভেতর থেকে গড়ে ওঠে নি। এই কাজের অপরিসৈম গুরুউত্ব ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের শেখাবে বলে মনে হয়।

আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১৩ সালের ২৩ মে তারিখে ‘গ্লোবার ওয়ার অন টেরর’-এর ইতি ঘটান, কিন্তু এটাও জানালেন, যে সকল সুনির্দিষ্ট গ্রুপ বা নেটওয়ার্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিনাশ করতে সংকল্পবদ্ধ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলবে। ২০১৪ সালে ১৮ ডিসেম্বর বারাক ওবামা আফগানিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধংদেহি ভূমিকার অবসানও ঘোষণা করলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতির সময় সীমা বাড়ালেন। তবে বাইডেন প্রশাসন আসার পর অনেকটা আক্স্মিক ভাবে ১৫ অগাস্ট ২০২১ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে আফগানিস্তান ত্যাগ করে।

কিন্তু যে দিকটি বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় সেটা হোল ২০২০ সালে বিশ্বের সামরিক খরচ বেড়ে প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৯৮১ বিলিয়ন ডলারে ছুঁয়েছে (দেখুন, ‘World military spending rises to almost $2 trillion in 2020’। এ হিসাব স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই)। করোনা মহামারির আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের চেয়ে এই ব্যয় ২.৬% বেড়েছে। সারা দুনিয়ায় সামরিক খাতে ব্যয়ের জন্য যে দেশগুলো সামনের সারির তাদের মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, ভারত, রাশিয়া এবং ইউনাইটেড কিংডম। এই দেশগুলোর সামরিক খাতের ব্যয় দুনিয়ার সকল দেশের মোট ব্যয়ের ৬২ ভাগ। মনে রাখতে হবে এর মধ্যে করোনা অতিমারিতে সকল দেশই কমবেশী পর্যুদস্ত হয়েছে, কিন্তু সামরিক খাতের ব্যয় কমে নি, বরং বেড়েছে।

৫. মারণাস্ত্রের ব্যবসা বা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কিলিং

এটা পরিষ্কার পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের প্রধান ও বিশাল একটি খাত হচ্ছে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কিলিং অর্থাৎ একসঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষ হত্যা করা যায় সেই রকম মারণাস্ত্র উৎপাদন। বিজ্ঞান ও টেকনলজি বিকাশের প্রধান নির্ধারকও মারণাস্ত্র উৎপাদন। একালে নতুন যে সকল টেকনলজি আমরা ব্যবহার করি তার বড় অংশের আবিষ্কারও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্য দিয়ে বাজারে আসে মারণাস্ত্র সংক্রান্ত গবেষণার ফল হিশাবে। এই খাত কেবল আবিষ্কার ও উৎপাদন করে টিকে থাকতে পারে না, তার একটা বাজার তৈরি করতে হয়। কিন্তু মারণাস্ত্রের বাজার তৈরি করা বা বিক্রি করাই যথেষ্ট নয়, বাজার সম্প্রসারণ করতে হলে বিক্রিত মারণাস্ত্র-পণ্যের ব্যবহারও বাড়ানো চাই। মারণাস্ত্রের ব্যবহার একমাত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়েই সম্ভব। তাই যুদ্ধ ছাড়া পুঁজিতান্ত্রিক বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক পণ্য হিশাবে আন্তর্জাতিক বাজারে মারণাস্ত্রের ভূমিকা বাদ দিয়ে আমরা বর্তমান যুদ্ধবিগ্রহের যৌক্তিক কারণ দাঁড় করাতে পারব না।

তাই আফগানিস্তানের যুদ্ধ শেষ হবার পর পরই আমরা ইউক্রেনে আরেকটি যুদ্ধ দেখছি। এর কারণ হিশাবে যে ব্যাখ্যাই আমরা দেই না কেন, সেটা হবে বাহ্যিক। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পণ্য হিশাবে সমরাস্ত্র উৎপাদন এবং তার বাজার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে যুদ্ধ ছাড়া গতি নাই । পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার গোড়ায় রয়েছে মারণাস্ত্র উৎপাদনের বাজার এবং তা সচল রাখার তাগিদ। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্গত স্বভাবের কারণে আফগানিস্তানের পরপরই ইউক্রেনের যুদ্ধ অনিবার্য ছিল।

এই কথাটা জোর দিয়ে বলার জন্যই আমাকে এখানে দীর্ঘ ভূমিকা দিতে হোল। বিভিন্ন পক্ষ যুদ্ধের যে কারণ দেখাচ্ছে আমরা তা এই বাস্তবতা মনে রেখে বিচার করে দেখতে পারি। সেই ক্ষেত্রে পুঁজি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছে তার পতন আসন্ন কিনা সেটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। যুদ্ধের পাশাপাশি দুই পক্ষের তরফে যে মতাদর্শিক যুদ্ধ চলছে তার মর্মবস্তু এই জিজ্ঞাসার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে।

ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বে সামরিক খাতে খরচ বাড়বে। দুই হাজার একুশ সালের হিশাব এখনও পাওয়া যায় নি, তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ইউরোপে মারণাস্ত্রের চাহিদা বাড়তে বাধ্য এটা অনুমান করা যায়। এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ছাড়াও ইউরোপের অর্থনৈতিক সুবিধা রয়েছে। পুরানা মজুদ অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখানে যুক্ত হবে নতুন মারণাস্ত্র। পুঁজির সমরাস্ত্র উৎপাদন খাতে বলবৃদ্ধি ঘটবে। ন্যাটো দেশগুলো আগে কিছুটা শিথিল হলেও এখন ব্যাপকভাবে অস্ত্র সংগ্রহ ও কেনাকাটার দিকে ঝুঁকবে।

৬. যুদ্ধ, নীতিবাগীশগিরি ও ‘সাম্রাজ্যবাদ’

রাশিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে। ইউক্রেনে রুশ হামলার মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া বা প্যালেস্টাইন – বিশেষত গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে যুদ্ধের ভৌগলিক স্থান ইউরোপের দিকে সরছে। এই ভৌগলিক অবস্থান্তর গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ ইউরোপে পৌঁছেছে। প্রথম শিক্ষণীয় হচ্ছে যারা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ধরে নিয়েছিলেন ‘সাম্রাজ্যবাদ’ নামক লেনিনীয় ধারণার কবর হয়ে গিয়েছে তারা দেখবেন কথাটা ঠিক না। একচেটিয়া পুঁজির প্রতিযোগিতা লেনিনের কথা মতো আরও তীব্র হয়েছে। এমনই যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথাও শোনা যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ‘দুনিয়ার ভাগ-বাঁটোয়ারা’ কিভাবে করে তার একটা সমকালীন ছবি আমরা ইউক্রেন যুদ্ধে দেখব।

‘সাম্রাজ্যবাদ’ সম্পর্কে লেনিনের ধারণার পুনর্পাঠের কথা বলছি প্রাচীন কমিউনিস্ট পার্টির অনুকরণের জন্য নয়, বরং যে শিক্ষা খোদ ইতিহাস বিশ্ব ব্যাপী গরিব ও সর্বহারা জনগণ পেয়েছিল তার সারকথা মনে রাখবার জন্য। রাজনীতির ভুলচুক এবং বিপর্যয় সত্ত্বেও সেই শিক্ষা যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি। সাম্রাজ্যবাদের যুগে যুদ্ধ অনিবার্য – লেনিনীয় এই সত্যের বিশেষ হেরফের হয় নি। তাই যুদ্ধকে নীতিনৈতিকতা বা নীতিবাগীশতাগিরি দিয়ে বোঝার উপায় নাই। অর্থাৎ এই যুদ্ধে কার দোষ, রুশরা খারাপ নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর অন্তর্ভূত ইউরোপ? নাকি ইউক্রেনের নীল চোখ আর সোনালি চুলের মানুষদের ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত হবার বাসনা? – ইত্যাদি দিয়ে এই যুদ্ধ বোঝা যাবে না। এটা পরিষ্কার যে জবরদস্তি – অর্থাৎ বলপ্রয়োগ ও ডিক্রি জারি এবং মানুষকে বস্তুসর্বস্ব মাটির ডলা জ্ঞান করে সমাজতন্ত্র কায়েমের স্থানীয় প্রচেষ্টাগুলোর বিনাশ ঘটেছে। পুঁজি বিশ্ব ব্যবস্থাকে নতুন ভাবে সাজাতে পেরেছে, পুঁজির অন্তর্গত চরিত্রের কোন বদল না ঘটিয়ে। পুরানা মার্কসবাদ আর ফিরে আসবে না। লেনিনবাদও না। কিন্তু ধনতন্ত্রের বিকাশ সবময়ই অসম । এটাও এখন পরিষ্কার পুঁজির সাম্রাজ্যবাদী পর্যায় বিশ্ব ইতিহাস অতিক্রম করে যায় নি -- এই সত্যগুলো পুরানা হয় নি। কিন্তু পুরানা সত্য আমাদের নতুন ভাবে ও নতুন রূপে আবিষ্কার করতে ও বুঝতে হবে। প্রা

প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে কয়েক টুকরা হয়েছে, জাতি ও পরিচয়ের ভেদ প্রবল হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক কালপর্বের অবসানের পর রুশ দেশে গড়ে উঠেছে নব্য ধনি শ্রেণী এবং একই সঙ্গে তাদের মধ্য দিয়ে রুশ পুঁজির দাপট, শাসন ও আইন (Oligarch)। নব্য রুশ অলিগার্ক জাতিবাদী রুশদের পুরানা আধিপত্য ফিরে পেতে চায় রাশিয়ার জন্য বাড়তি প্রেমের জন্য না, বরং তাদের পুঁজির স্ফীতি, পুঞ্জিভবন ও বিস্তৃতির দরকারে। রুশদের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের স্বপ্ন এখনও মরে নি – এভাবে বুঝলে বর্তমান রাশীয়া সম্পর্কজে আমাদের বোঝাবুঝি সম্পূর্ণ হবে না। রুশ নব্য পুঁজিতন্ত্র নতুন রুশ জাতিবাদকে পোক্ত করতে চাইছে কারন এর দ্বারাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রুশ পুঁজি অন্যন্য পুঁজির সঙ্গে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা – এমনকি যুদ্ধেও লিপ্ত হতে পারে।

৭. বিশ্বব্যবস্থার নতুন খেলোয়াড়

চিন বিশ্বে নতুন খেলোয়াড় হিশাবে হাজির হয়েছে। মিলিটারি হার্ডওয়ার বা বলপ্রয়োগ দ্বারা পরদেশ দখলের নীতি অনুসরণ না করে খোদ পুঁজি এবং নতুন বৈশ্বিক অবকাঠামো নির্মানে বিপুল বিনিয়োগ করছে চিন। অর্থাৎ বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পকে চিন তার প্রভাব বলয় সম্প্রসারণের হাতিয়ার হিশাবে ব্যবহার করছে। পুঁজির প্রতিযোগিতার আরেকটি রূপ আমরা দেখছি। একসময় পুঁজিবাদী বৃহৎ শক্তি জার্মানি অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশ, যেমন ব্রিটেনের তুলনায় অনেক দ্রুত বেড়ে উঠেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই জার্মানি গোটা পৃথিবীর সম্পদ, বাজার এবং এলাকার বড় ভাগটা পেতে চেয়েছিল। যেহেতু “বিশ্বের ভৌগলিক বিভাজন ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল” – উপনিবেশ স্থাপন এবং লুন্ঠন ও বাজার ব্যবস্থার ওপর একচেটিয়া কায়েমের মধ্য দিয়ে -- তাই লেনিন দাবি করেছিলেন পুনর্বিভাজন সম্ভব ছিল একমাত্র যুদ্ধের দ্বারা।

এখনও আবার বিশ্বের পুনর্বিভাজন জরুরি হয়ে পড়েছে। বাজার ব্যবস্থার বৈশ্বিক বিকাশ – বিশেষত মুদ্রা ব্যবস্থা বা ডলারকেন্দ্রিক লগ্নিদার সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার শক্তিশালী বিস্তৃতি, টেকনলজি – বিশেষত তথ্য ও ডিজিটাল টেকনলজির দুর্দান্ত অগ্রগতি এবং নজরদারি বা কোটি কোটি মানুষের ইচ্ছা, কামনা বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের শাসন ও শৃংখলার মধ্যে রাখার নতুন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (Biopolitics) বর্তমান পুনর্বিভাজনের কেন্দ্রীয় বিষয়।

কিন্তু লেনিনের আদি থিসিসের বিশেষ হেরফের হয় নি। বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তি বা গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় পুঁজির আভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতা থেকে। তাই পুঁজির স্বভাব বোঝার চেষ্টা না করে শুধু দেশ, জাতি, ভূগোল বা ভূ-রাজনীতি দিয়ে বিশ্বকে বোঝার চেষ্টা হবে শুধু বাহিরকে বাহির থেকে দেখা। অন্দরে কি ঘটছে তার কিছুই আমরা বুঝব না। আমরা বিভ্রান্তই থেকে যাব। দেশ, রাষ্ট্র, জাতি, জাতিবাদ, ভূ-রাজনীতি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নাই। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা কিভাবে পরস্পরের প্রতিযোগী জাতিবাদ, রাষ্ট্র ও শক্তিবলয় তৈরি করছে সেটা বোঝার দরকার আছে। কিন্তু যতক্ষণ না আমরা সাম্রাজ্যবাদ – অর্থাৎ পুঁজির স্বভাব না বুঝি ততক্ষণ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় বিভিন্ন গোষ্ঠি, কর্পোরেশান বা শক্তি কিভাবে বাজারে একচেটিয়া এবং নিজের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করতে চাইছে তার গতিপ্রকৃতি বুঝব না। সেই দিকেই আমাদের নজর নিবদ্ধ থাকা উচিত। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের স্বার্থের দিক থেকেও তখন আমাদের আগামি রাজনৈতিক তৎপরতার অভিমুখ ও রূপ কি হতে পারে তার একটা দিশা তখন আমরা পাব। ন্যাটো বা ইউরো-মার্কিন অক্ষের পক্ষাবলম্বন করে রাশিয়ার আগ্রাসন নিন্দা করা যেমন অর্থহীন, তেমনি ন্যাটো রাশিয়াকে চারদিক থেকে অস্ত্র দিয়ে ঘিরে ফেলেছে অতএব রাশিয়ার ইউক্রেন হামলা সঠিক – অর্থাৎ রুশ প্রতিরক্ষার যুক্তিতে পুতিনকে সমর্থনও অযৌক্তিক।

ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ইউক্রেন যুদ্ধকে ইউরো-মার্কিন সামরিক শক্তি বনাম ইউরেশিয়ার দ্বন্দ্ব হিশাবে অনায়াসেই আন্দাজ করা যায়। তবে পাশ্চাত্য গণমাধ্যমের প্রপাগাণ্ডায় একে একান্তই রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই হিশাবে ফেরি করা হচ্ছে। সার্বভৌমত্বের কেচ্ছা দিয়ে সার্বভৌমত্ব হরণ করাই একালের রাজনীতি। বাংলাদেশ যেমন একটি উদাহরণ। তাই ‘সার্বভৌমত্ব’-এর নামে ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর পারমাণবিক যুদ্ধের ফ্রন্ট বানাবার পরিকল্পনা বিরোধিতার দরকার আছে। ‘জাতি’র নামে – অর্থাৎ নানান কিসিমের জাতিবাদের নামে দলিত, আদিবাসী, গরিব ও সর্বহারা শ্রেণীকে বিভক্ত ও খণ্ড খণ্ড করা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তির রাজনীতি। ইউক্রেনেও এই ঘটনাই ঘটেছে, ‘জাতি’র নামে ইউক্রেনের জনগণের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাঁধানো হয়েছে। এই ফাঁদে পড়ে আমাদের খাবি খাবার কোন দরকার নাই। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ‘সার্বভৌমত্ব’ নামক ওয়েস্টফিলিয় ধারণা সোনার পিতলা কলসের মতো বকোয়াজগিরি। এতে রাশিয়াকে নিন্দা করার সুবিধা। তবে এর পালটা মতও প্রভূত শক্তিশালী। এই মতের দাবি হচ্ছে রাশিয়ার যুক্তিসঙ্গত নিরাপত্তা-উদ্বেগকে ইউরো-মার্কিন অক্ষশক্তি আমলে নেয় নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অনেক বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দাবি করছেন ইউক্রেনের সংকটকে যুদ্ধাবস্থায় ঠেলে দেওয়ার জন্য মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্ররাই দায়ী।

অভিযোগ আর পালটা অভিযোগের ডামাডোলে প্রবেশ করে লাভ নাই। দেখা যাচ্ছে এই যুদ্ধ ন্যাটো বনাম রাশিয়ার যুদ্ধ। ইউরো-মার্কিন সমর-ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হচ্ছে ন্যাটো। এই যুদ্ধে চিন এখনও সরাসরি দৃশ্যমান নয়। এখনও উহ্য – চিন সরাসরি হাজির নাই। তদুপরি চিনের একটা স্বাধীন অবস্থানও আছে – কিন্তু যে দিকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে এবং ইউরো-মার্কিন শক্তির বিপরীতে বিচার করলে রাশিয়াকে একা ভাবার কোন কারন নাই। এই যুদ্ধ মর্মের দিক থেকে ইউরোপ বনাম এশিয়ার যুদ্ধ বলে সন্দেহ করবার যথেষ্ট কারণ আছে। চিন এটা বোঝে। এমনকি মোদির ভারতও বোঝে। এই যুদ্ধ ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কে বিস্তর পরিবর্তন আনবে। দক্ষিণ এশিয়া সেই পরিবর্তনের বাইরে থাকবে না।

৮. খাজনা আদায় বনাম উৎপাদন

রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংকশান আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে দাবি করছেন এর ফল হবে বিশ্বের অধিপতি হিশাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয় দ্রুততর হওয়া এবং চিনের শক্তিশালী আবির্ভাবকে আরও পাকাপোক্ত করা। এ কথা বলার পেছনে প্রধান যুক্তি হচ্ছে ডলার কেন্দ্রিক বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থার বিপরীতে চিন, ইরান, রাশিয়া এবং সম্ভাব্য আরো কয়েকটি দেশ মিলে পালটা নতুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা পরিগঠিত হবার সম্ভবনাকে আরও অনিবার্য করে তোলার দিকে ঠেলে দেওয়া। ডলার এখন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম। সেই অবস্থান টিকিয়ে রাখার ওপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বৈশ্বিক আধিপত্য নির্ভর করে। ডলারের বিকেন্দ্রীকরণ – অর্থাৎ বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থার প্রধান বিনিময় মাধ্যম হওয়ার অবস্থান থেকে চ্যূত হওয়া একই সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যের ক্ষয়ও বটে।

‘সাম্রাজ্য’ শব্দটা পুরানা – সামন্ততান্ত্রিক। তবে টেকনলজি – বিশেষত ডিজিটাল ও মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কারিগরি, ডলার এবং পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক মিলে যে বিশ্বব্যবস্থা বিদ্যমান তাকে অনেকে ‘টেকনো-ফিউডালিজম’ বলেন। এতে বিশ্বব্যবস্থার চরিত্র বোঝার সুবিধা। সেটা মনে রাখলে ‘সাম্রাজ্য’ ধারণাটির নতুন ব্যবহারে অসুবিধা নাই। আমরা বৈশ্বিক সাম্রাজ্য-ব্যবস্থার মধ্যে বাস করি। বামপন্থিরা আগে পাশ্চাত্যের পরদেশ দখল, সম্পদ লুন্ঠন প্রক্রিয়া এবং পুরানা ঔপনিবেশিক আইন, বিধিবিধান ও রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী যে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল তাকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে চিহ্নিত করত। এর মধ্য দিয়ে একটা বোঝাবুঝির ধারা আছে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর এবং চিনের পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ দৃশ্যমান হয়ে ওঠার পর থেকে বামদের ভাষা ব্যবহারের চল কমে গিয়েছে। কিন্তু তাতে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ উবে যায় নি। তবে এ কালের ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বুঝতে হলে বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার লগ্নিদারি খাসিলত (Financialization of Global Economy), ব্যাংক এবং কর্পোরশান বুঝতে হবে। এই দিকগুলো গুছিয়ে সহজ করে সাধারণ পাঠকের জন্য বলা জরুরি, তবে সেটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। সাম্রাজ্যবাদকে আগে ভৌগলিক বিস্তার হিশাবে দেখা হোত, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো দুনিয়াকে নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়েছিল। সেটা সম্ভব হয় সামরিক শক্তির ওপর। ফলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে সমরাস্ত্রের প্রতিযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক।

একালে অবশ্য ভূখণ্ড, কাঁচামাল কিম্বা বাজার দখলই যথেষ্ট নয়, সার্বজনীন মূদ্রা হিশাবে স্বর্ণের পরিবর্তে টাঁকশালে ছাপানো কাগজের মুদ্রা বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠার পর থেকে সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রীয় শক্তি তারাই থাকতে পারে যারা বিশ্ব বিনিময় ব্যবস্থার সার্বজনীন মাধ্যম হিশাবে নিজেদের মূদ্রাকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত রাখতে সক্ষম হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতোকাল ডলারকে সেই স্থানে বসিয়ে রাখতে সক্ষম ছিল। সেখানে চিড় ধরেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এই দিকটিকে আরও স্পষ্ট করে তুলবে। ফলে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্যে বদল আসন্ন হয়ে উঠেছে বলেই মনে হয়। ইউক্রেন হামলার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার ওপর স্যাংকশান বা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ফল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিশাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতনকেই ত্বরান্বিত করবে।

আরও কয়েকটি দিক বোঝা জরুরি। সেটা হোল বিনিয়োগ, গবেষণা, বিজ্ঞান ও টেকনলজি ইত্যাদি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তির কারন হিশাবে মনে হয় এই দেশ শীর্ষে রয়েছে ডলারকে দ্রুত বিনিয়োগে রূপান্তরিত করবার ক্ষমতায়। সেটা আসলে একদমই ঠিক না। টাকা বা ডলার মানেই ‘পুঁজি’ না। মার্কিন টাঁকশাল চাইলেই ডলার ছাপতে পারে, কিন্তু তাতে ডলার ‘পুঁজি’ হয়ে যায় না। কিম্বা আপনা আপনি বিশ্ব মুদ্রার স্বীকৃতি পায় না। বিশ্ব বিনিময় ব্যবস্থায় ডলারের ভূমিকা বা ক্ষমতার কারণ বুঝতে হলে ‘পুঁজি’ বোঝা দরকার। যারা কার্ল মার্কস পড়েন নি, বা না পড়লেও অর্থশাস্ত্র বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বুঝবেন মনে করেন, তাদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলা কঠিন। আমামদের প্রথাগত বোঝাবুঝিকে ধোঁকা দিয়ে চিন যে বৈপ্লবিক অর্থনৈতিক বিপ্লবের পথ গ্রহণ করে সফল হয়েছে সেটাও সম্ভব হয়েছে মার্কসের ‘পুঁজি; বিশ্লেষণ থেকে শিক্ষা নিয়ে। কারণ ‘পুঁজি’ কিভাবে চলে, তার বিচলন চক্র কেমন, তার স্বভাবচরিত্রের বৈশিষ্ট্য কি? -- মার্কস না পড়লে সেইসব বোঝা অসম্ভব।

আপাতত এতোটুকু আমাদের বোঝাবুঝির মধ্যে থাকা উচিত যে টাকা, ডলার বা, ইয়েন স্রেফ টাঁকশালে ছাপানো টাকা। রাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই টাঁকশালে টাকা ছাপতেই পারে, কিন্তু তার ‘মূল্য’ উসুল করতে হলে কাগজের টাকাকে বিনিয়োগে রূপান্তর করতে হবে। অর্থাৎ উৎপাদনে রূপ দিতে হবে। বৈপ্লবিক অর্থনৈতিক রূপান্তরে চিনা কৌশল হচ্ছে কাগজকে দ্রুত বিনিয়োগে নিয়ে যাওয়া বা উৎপাদনে রূপ দেওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে যে ডলার চিন আয় করেছে তাকে শুধু নিজের দেশে না, বরং সুদূর প্রসারী রূপান্তরের কথা ভেবে বিপুল অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় করছে অকাতরে। কারণ চিন জানে এই কাজটা করা না গেলে কাগজ ছাড়া ডলারের আর কোন মূল্য নাই। চিন তার সামরিক ও নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছে বেল্ট এন্ড রোড বৈশ্বিক প্রকল্প দিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের অর্থনীতি আসলে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল দ্বৈত অর্থনীতি। চিন এই পারস্পরিকতাকে দুর্বল করতে চায় না। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্য থেকে আয় করা উদ্বৃত্ত মূদ্রাকে ত্বরিৎ বিনিয়োগে নিয়ে যাওয়ার সামর্থের ওপর আগামি বিশ্ব ব্যবস্থায় নেতৃত্ব কায়েম হবে চিন এই সত্য টের পেয়ে গিয়েছে। কিভাবে চিন তা বাস্তবায়ন করছে সেটাই এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারছি। রাশিয়ার যুদ্ধ একই সঙ্গে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চিনের ‘প্রক্সি ওয়ার’ বলা যায়। চিনের নিজের নিরাপত্তা বলয় হিশাবে নতুন ইউরেশিয়ার জন্ম দিতে চাইছে। এই যুদ্ধ সেই পরিকল্পনাকে আরও স্পষ্ট ও মূর্ত করে তুলবে।

চিনের বিপরীতে পালটা মার্কিন অর্থনীতির ভিত্তিকে বলা যায় খাজনা আদায়ের অর্থনীতি। এটা পুরানা সামন্তবাদী কায়দা। যেমন, জমির টাইটেল বা মালিক হবার কারণে জমিদারদের খাজনা আদায় করারা মতো। তেমনি উৎপাদন না করে টাকা ভাড়া দিয়ে সুদ খাওয়া। খাজনা আদায়ের আরেক প্রকার অর্থনীতি আছে। বুদ্ধি বা আবিষ্কারের বিপরীতে খাজনা আদায় করা। যেমন নতুন আবিষ্কারের প্যাটেন্টের জন্য রয়ালটি বা আবিষ্কারের খাজনা আদায়। এক কথায় এই সবই এক কথায় উৎপাদন বর্জিত খাজনাকারি অর্থনীতি (Rentier Economy)। মুদ্রা ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেমন টাকা ধার দিয়ে সুদের আদায় করে সারা দুনিয়ার মানুষকে শোষণ করে। তেমনি বুদ্ধিজাত সম্পত্তি (Intellectual Property Right) ব্যবস্থায় আবিষ্কার থেকে রয়াল্টি বা খাজনা আদায় বা শোষণ পদ্ধতিও উৎপাদন বর্জিত। বড় বড় কোম্পানিগুলো কম খরচে চিনে তাদের পণ্য উৎপাদন করে। তাদের ব্রান্ড নামকে তার পণ্য পরিণত করে। যার জন্য একালে ব্যবসাতে ‘ব্রান্ডিং’ খুবই পরিচিত পরিভাষা। যা মূলত খাজনাকারী অর্থনীতির দ্যোতক। এই দিকটি বুঝলে আমরা ধরতে পারব কেন মার্কিন দেশের পণ্য মার্কিন দেশে উৎপাদন না করে চিনে উৎপাদন করা হয়। এর রহস্য কি? রহস্য হচ্ছে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি মুনাফা করে আবিষ্কার ও টেকনলজির ওপর বুদ্ধিজাত সম্পত্তির খাজনা আদায়ের মাধ্যমে, তাদের পণ্য তারা নিজ দেশে উৎপাদন করার চেয়েও চিনে উৎপাদন করে কারণে এতে খরচ কম হয়। বলাবাহুল্য এই বিষয়গুলোর আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যার দরকারে আছে। কিন্তু বলে রাখছি কারণ যুদ্ধকে একালে স্রেফ বাইরে থেকে সামরিক বিষয় মনে করার কোন কারন নাই। পুঁজির আন্তর্জাতিক চরিত্র না বুঝলে এই দিকগুলো আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে না। এই বোঝাবুঝি পরিষ্কার থাকলে এটা পরিষ্কার হবে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে – খাজনাকারী অর্থনীতি যার মূলে -- তার দ্রুত পতনের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ।

৯. এ বিশ্ব বাগানে সাঁই নিরঞ্জনে...

বলাবাহুল্য যুদ্ধের খবরাখবর আমরা যার যার মতো রাখবার চেষ্টা করছি। কিন্তু রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের জন্য বাংলাদেশে মূল প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে এই যুদ্ধকে আমরা বুঝব? ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে এই চলমান যুদ্ধ নিয়ে কিভাবে আমাদের ভাবা উচিত? আমাদের ভাবনাকে আকাশকুসুম না বানিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান কালের যুদ্ধবিগ্রহ আমাদের বোঝা উচিত।

বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের দিক থেকে আমাদের প্রাথমিক ও প্রধান উৎকন্ঠা কি হওয়া উচিত? যুদ্ধের ভূক্তভোগী সাধারণ মানুষের জন্য উদ্বিগ্ন থাকাটাই আমাদের জন্য এখন সবচেয়ে সমীচিন কাজ। দরকার পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা এবং সাম্রাজ্যবাদী ডামাডোলের উর্ধে নজর রাখা। কিন্তু সেটা হতে হবে পক্ষ নির্বিশেষে। সাধারণ মানুষের কথা মনে রাখতে হবে সব সময়ই। কারন যুদ্ধের দামামায় যারা মারা পড়ে , বলা যায়, তারা একদিক থেকে বেঁচে গেল। কারন যারা বেঁচে থাকে তাদের অধিকাংশই গুরুতর মানসিক ও শারিরীক ভাবে পঙ্গু হয়ে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। যুদ্ধ শেষে জীবিত থেকেও তারা পরাস্ত। সেই মানুষগুলোর খবর কেউ সাধারণত রাখে না। তারা হারিয়ে যায়। বিশাল একটা অংশ রিফিউজি বা শরণার্থী হয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। দেশ হারা গৃহ হারা উন্মূল উদ্বাস্তুর হাহাকার ইতিহাসে সবসময়ই চাপা পড়ে যায়।

তবে যুদ্ধাক্রান্ত ইউক্রেন থেকে দেশ ছেড়ে যারা অন্য দেশে শরণার্থী হচ্ছেন ইউরোপ তাদের সাদরেই গ্রহণ করছে। তবে শুধু তারাই সাদর অভ্যর্থনা পাচ্ছে যাদের চুল সোনালী এবং চোখের মণি নীল। কিছুদিন আগেও আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থিদের অনেকে ইউরোপে ঢুকতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কারন তাদের চামড়া বাদামি।।

ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে সাদরে রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, আর পোলান্ড আশ্রয় দিচ্ছে। এই দেশগুলোর মানবতার জন্য প্রশংসার শেষ নাই। সীমান্ত খুলে দিয়েছে সব ইউরোপীয় দেশ। কারণ শরণার্থীদের অধিকাংশই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বি এবং তাদের গায়ের চামড়া সাদা। মানবতার চূড়ান্ত অভিপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে বটে -- কিন্তু বোঝা যাচ্ছে মানবতা সার্জনীন হতে পারে নি এখনও। এখানে দেখা যাচ্ছে মানবতা শুধু সাদা আর নীল চোখের মানুষদের জন্য নির্ধারিত। কালো, শ্যমল বা হলুদদের জন্য সেই কাতরতা নাই। ইউরোপের রাষ্ট্রনায়করা খোলামেলাই দাবি করছেন যে এরা সিরিয়া, সোমালিয়া, সুদান, ফিলিস্তিন কিম্বা অসভ্য বা বর্বর দেশ থেকে আসা শরণার্থী না। ইউরোপ বলছে ইউক্রেনের শরণার্থীরা আমাদের মতোই (‘people like us’)।

শরণার্থিদের আসা সহজ করতে পুরানা ফাইলের তলে চাপা পড়া আইনগুলোকে ইউরোপিয়া ইউনিয়ন আবার সক্রিয় করছে।হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী হিক্টর ওর্বান ঘোষোনা দিয়েছে, ‘সবাইকে তারা তাদের দেশে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন। পোলান্ড বলছে কারো যদি বৈধ কাগজপত্র (official) না থাকে, তবু তাদের তারা ঢুকতে দিচ্ছে। এমনকি তারা কোভিড-১৯ সংক্রণে ভুগছে না, উরথাৎ টেস্টে নেগেটিভ এমন কোন ডাক্তারি কাগজপত্রও দেখাতে হবে না। পোলিশ প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদা বলেছেন, “যুদ্ধের ট্রাজেডি থেকে পালিয়ে আসা অনেক শরণার্থী আমাদের গ্রহণ করতে হবে। পোলিশ রাজনীতির দক্ষিণপন্থি দল গুলো দীর্ঘকাল ধরে অভিবাসনের বিরোধিতা করে আসছিল কড়া ভাবে। হানগেরির ভিক্টর অর্বান ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অভিবাসন নীতির একজন করা সমালোচক। দুই হাজার আঠারো সালে অর্বান দাবি করেছিলেন “ভিনদেশের মানুষদের অভিবাসন অনুমোদন জনগণের নিরাপত্তার জন্য, আমামদের মঙ্গল ইউরোপের খ্রিস্টিয় সংস্কৃতির জন্য বিপজ্জনক। বুলগেরিয়ার প্রধান্মন্ত্রী কিরিল পেটকভ (Piril Petkov) সাংবাদিকদের কাছে কাছে খোলা মেলাই বলে ফেলেছিলান, “এইসব শরণার্থিরা বুদ্ধিমান ।যেসব রিফিউজির সঙ্গে আমরা পরিচিত – যাদের পরিচয়ের সম্পর্কে আমরা ঠিক জানি না –যাদের অতীত আমরা জানি না, তারা টেররিস্টও হতে পারে -- এরা তো তারা না, এইসব (ইউক্রেনের) শরণার্থীরা ইউরোপীয়। বলা যায় ইউরোপের এমন কোন দেশ নাই যারা এই রিফিউজিদের এই ঢল দেখে ভীত”।

পেটকভের মন্তব্য নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে। তবে ইউরোপের বাইরের জনগোষ্ঠীর প্রতি ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গী পেটকভের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশেষ আলাদা না। যারা ইউরোপীয় না, তাদের বুদ্ধি কম। পড়াশুনা নাই। তাদের অতীত অপরিচ্ছন্ন এবং তারা সন্ত্রাসীও হয়। অতএব ভয়ংকর।

সিরিয়া থেকে যেসকল শরণার্থী ইউরোপে গিয়েছিল তাদের অধিকাংশই ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। গৃহযুদ্ধ এড়াতে তারা দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিল। সিরিয়ায় কমপক্ষে চার লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে। মধ্য প্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার সংঘর্ষ-সংকুল দেশগুলো থেকে রিফিউজিদের ইউরোপে পাড়ি দেওয়া সহজসাধ্য ছিল না।

রিফিউজি বা শরণার্থী একালে ভূ-রাজনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান – বিশেষত মানবাধিকার, সার্বভৌমত্ব এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রীয় বিষয়। যুদ্ধে আক্রান্ত ইউক্রেনের শরণার্থীদের কেন্দ্র করে বর্ণবাদ বা রেসিজম সামনে চলে আসাটা ইউরোপকে বোঝার জন্য খুবই দরকারি। ইউরোপের পুষে রাখা বর্ণবাদ প্রকাশিত হয়ে যাওয়া খারাপ হয় নি। ইউরোপের মনের অন্দর মহলে বিষবাষ্পটা জমা আছে – এটা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় থাকা উচিত।

বাংলাদেশে আমরা কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস পড়ি নি। জানি না। বাংলাদেশে যারা নিজেদের প্রবল ধার্মিক মনে করেন তারা ইসলামের আবির্ভাবের ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস কিছুই প্রায় জানেন না বললেই চলে। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছেন। যারা সেকুলার বলে নিজেদের দাবি করে এদের প্রায় সকলেই বর্ণবাদী সাদা সভ্যতা এবং তার আধুনিক পরিণতি পাশ্চাত্যকে নির্বিচারে সভ্যতার মানদণ্ড গণ্য করে।

‘সাদা’ চামড়ার রঙটাও এখানে আসল কথা না, আসলে সাদাবর্ণ ইতিহাসেরই রঙ বটে। চামড়া সাদা হলেই কেউ বর্ণবাদ বা সাদা সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব মানে তার কোন যুক্তি নাই। সাদা হওয়া মানেই বর্ণবাদী হওয়া নয়। কিন্তু বর্ণবাদের যে ইতিহাস তার সঙ্গে বর্ণবাদীর গায়ের চমড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েই ইতিহাস হয়েছে । ইতিহাস যাকে জোড়া দিয়ে রেখেছে তার মোচন ইতিহাসের মধ্য দিয়েই ঘটাতে হবে। বর্ণবাদ ঐতিহাসিক বলে যে রঙে আমরাও বাস্তব ইতিহাসের ভূমিকায় যখন নামি – ইতিহাস বদলাবার কথা বলি -- তখন সাদা রঙে সাদা হয়ে সাদা সভ্যতার পক্ষেই আমরা দাঁড়াই। আমরা কালো ঘৃণা করি। ইতিহাস সাদার শ্রেষ্ঠত্ব এমন ভাবে আমাদের চিন্তায় ও কল্পনায় বিঁধে দিয়েছে যে সভ্যতা বলতে আমার সাদা বর্ণই বুঝি। কৃষ্ণ ঘোর কালো হলেও দেখা যায় তাকে নীল রঙ না ভাবলে আমাদের ভক্তি আসে না। তাঁকে ভগবান ভাবতে গেলেও নীল রঙের ভগবান বানাতে হয়।

সাদা তাহলে শুধু ইতিহাসের রঙও নয়। সাদা এখন সার্বজনীন মন বা আমামদের সভ্যতার চেতনার কালার। এই রঙ ধূয়ে পরিষ্কার হওয়া খুবই কঠিন এবং দীর্ঘ লড়াইয়ের ব্যাপার। চামড়া ব্রাউন হলেও স্যূট-টাই প্যান্ট-শার্ট পরে আমাদের ভেতরের সাদাকে বাইরে প্রদর্শন করবার জন্য আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। আমাদের বিশ্বাস সাদা না হলে আমরা ‘সভ্য’ বলে পরিগণিত হব না। নিজেদের ধর্ম, নিজেদের স্থানীয় ইতিহাস, কিম্বা নিজেদের গল্প-পুরাণের মধ্যে – অর্থাৎ নিজেদের ভাবনাচিন্তা বেড়ে ওঠার ইতিহাসের মধ্যে আমরা মানবজাতিকে দেবার মতো কিছু খুঁজে পাই না। উপনিবেশ এবং সাম্রাজ্যবাদ আমাদের ভেতর-বাহির এমনই ধোলাই করে দিয়ে গেছে যে আমরা ঐতিহাসিক সাদা সভ্যতার নিকৃষ্ট গোলামের অধিক কিছু ভাবার কিম্বা নিজেদের অর্জন নিয়ে নিজেরা বিশ্বসভায় শিরদাঁড়া খাড়া করে দাঁড়াবার ন্যূনতম হিম্মতটুকুও হারিয়েছি।

অনেক দিন আগে যখন ইউরোপীয়রা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু করল সেই সময়ের কথা স্মরণ করে ডব্লু ই বি দুবয় (W. E. B. DuBois) সাদা বর্ণের মানুষগুলার ধ্বংসাত্মক উন্মাদনা (Culture of White Folks) সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে গিয়েছিলেন। ইউক্রেন কেন্দ্র করে যে বিশ্ব সংকট স্পষ্ট হয়ে উঠছে সেখানে পুরানা ময়লার গাদও ভেসে উঠছে।

যুদ্ধে প্রধান ভূক্তভোগী সাধারণ মানুষ। তারা যে পক্ষেরই হোক সাধারণ মানুষের সমব্যথী হওয়া গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শরণার্থি আমাদের প্রাথমিক ও প্রধান উৎকন্ঠা। যে দিকটায় আমরা দুর্বল সেটা হোল শরণার্থী ও অভিবাসনের প্রশ্নকে ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক উভয় দিক থেকে পর্যালোচনার পদ্ধতি আমাদের জানা নাই। আমরাও তো শরণার্থী বা অভিবাসী হয়ে অন্য দেশে আশ্রয় চাই। কিন্তু আমাদের চুল সোনালি, কিম্বা চোখ নীল না। তাছাড়া তথাকথিত ‘মুসলমান’ নামক মানুষগুলার কি হবে? বিশেষত যখন জাতিবাদী চিন্তা পাশ্চাত্যে প্রবল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মানুষ ইউক্রেনের শরণার্থিদের মতো খ্রিস্টান না। রক্ত, বর্ণ, গোত্র, জাতি, জাতিবাদ ও ধর্মীয় পরিচয়বাদ কিভাবে আধুনিক রাষ্ট্র এবং তথাকথিত সার্বভৌমত্বের নামে প্রয়োগ ও ব্যবহার করা হয় তার মাজেজা ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে আমাদের নতুন করে বোঝা জরুরি হয়ে পড়েছে। দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক সাহস ও হিম্মত। শরণার্থি ও অভিবাসনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে বাংলাদেশে শরণার্থী রোহিঙ্গার প্রশ্ন। আধুনিক রাষ্ট্র তত্ত্ব, তথাকথিত ‘সার্বভৌমত্ব’ এবং পাশ্চাত্যের আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের অন্তর্গত তথাকথিত ‘অধিকার’-এর সর্বহর দাওয়াইয়ের মুশকিলও আমাদের বোঝার দরকার আছে।

দুনিয়ায় জাতি একটাই, তার নাম মনুষ্য জাতি – বিভিন্ন বর্ণ, ভূগোল, ভাষা, সংস্কৃতি, চোখের ধরণ, নাকের আকার ইত্যাদি দারুন সব বৈচিত্র্য, বিভিন্নতা এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রতিভা সহ সারা দুনিয়ার বিভিন্ন মানুষ কিভাবে এক সাথে ‘এক’ হয়ে একই ভাবের অধীনে একত্রে একটি বিশ্বে বাস করতে পারে সেই তৌহিদী সূত্র পুনরাবিষ্কার ও নির্ণয় করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

‘এ বিশ্ব বাগানে সাঁই নিরঞ্জনে মানুষ দিয়া ফুটাইল ফুল…’ ।

 

২৭ মার্চ ২০২২ ।। শ্যামলী

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।